নাজেহাল ভোক্তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে কতখানি সচেতন ?

প্রকাশিত: ৩:৩০ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০২৫

শারফুদ্দীন সোহেল:

১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। বিশ্বের অনান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করা হয় ।

১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনিডি মার্কিন কংগ্রেসে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। এসময় তিনি ভোক্তার চারটি অধিকার “নিরাপত্তার অধিকার, তথ্য প্রাপ্তির অধিকার, প্রছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার’ সম্বন্ধে আলোকপাত করেন। ঐতিহাসিক দিনটির স্মরনীয় করে রাখতে ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিনটি সারা বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়।

বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রনয়ন করা হয়। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য একই বছরে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এ অধিদপ্তর। প্রতি বছর এ দিবসটিকে পালন করছে সরকারি এই সংস্থা। এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে আগে থেকেই ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে আসছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ – ক্যাব। সংগঠনটি আন্তর্জাতিক ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার ইন্টারন্যাশনালের পূর্ণাঙ্গ সদস্য। ক্যাবও দিবসটি উপলক্ষ্যে নানা আয়োজন করে থাকে।

ভোক্তা কে বা কারা:

ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে জানার আগে আমাদের জানতে হবে ভোক্তা কে বা কারা। সাধারণত যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলা যায়, যিনি নিজে ভোগ করার জন্য কোনো পণ্য ক্রয় করেন তিনিই ভোক্তা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী যিনি সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা বাণিজ্যিক উদ্দেশে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেন তিনি ভোক্তা।

ভোক্তা অধিকার বলতে কি বুঝায়:

মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম। একজন ভোক্তা কোনো পণ্য ক্রয় করার ক্ষেত্রে তার কিছু বিষয় জানার অধিকার রয়েছে। যেমন, পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি। এগুলো হল- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার। যদিও মৌলিক অধিকার দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭(ক) এ নিশ্চিত করা আছে।

এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আইন আছে দেশে। যেমন-তথ্য অধিকার আইন ২০০৯; নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩; পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০; ওজন ও পরিমাপ আইন ১৯৮২; অত্যাবশ্যক পণ্য সামগ্রী আইন ১৯৫৬ ইত্যাদি। এছাড়া ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন জারি করা হয়। বলা হয়েছে, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যক্রম রোধ ও এ সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য এ আইন প্রণীত হয়েছে। এ আইনে ৮২টি ধারা এবং অনেক ধারার উপধারা রয়েছে। আইনটিতে খাদ্য, পণ্য, চিকিৎসা,ওষুধ এবং বিভিন্ন ধরনের সেবায় ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

ভোক্তা অধিকার আইন বলবৎ থাকা সত্যেও সচেতনতা কেন প্রয়োজন :

আমাদের দেশে শিক্ষার হার খুব একটা যথেষ্ট নয়। সাধারণ ভোক্তা তো আছেন-ই, শিক্ষিত অনেক ভোক্তার মধ্যেও তাদের আইনি অধিকার নিয়ে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যার ফলস্বরূপ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আইন থাকার পরও কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে, বিধায় সচেতনতা গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পরেছে। ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগ ও প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মেডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচার করতে হবে, পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে আইনটি অন্তর্ভুক্ত করে এর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।

অভিযোগ কীভাবে দায়ের করতে পারবেন:

ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ধারা ৭৬ (১) অনুযায়ী, “যে কোন ব্যক্তি, যিনি, সাধারণভাবে একজন ভোক্তা বা ভোক্তা হইতে পারেন, এই আইনের অধীন ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য সম্পর্কে মহাপরিচালক বা এতদুদ্দেশ্যে মহাপরিচালকের নিকট হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবহিত করিয়া লিখিত অভিযোগ দায়ের করিতে পারিবেন।”
অর্থাৎ, ভোক্তা মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, উপপরিচালক, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়, সহকারী পরিচালক, ঢাকা জেলা কার্যালয় ও অন্যান্য জেলা কার্যালয়সমূহ এবং বিভাগের আওতাধীন প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। লিখিত আকারে, ফ্যাক্স, ই-মেইল ও অনলাইন ইত্যাদি মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করা যাবে।অভিযোগের আবেদনে অবশ্যই অভিযোগকারীর পূর্ণ নাম ও ঠিকানা, পিতা ও মাতার নাম, ফোন নম্বর এবং পেশা উল্লেখ করতে হবে।

অভিযোগ দায়েরের সময়সীমা :

ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ধারা ৬০ অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এই আইনের অধীন অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। অন্যথায় উক্ত অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না।

অভিযোগ দাখিলের পর ফলাফল (জরিমানার অর্থের ২৫% প্রদান) :

দায়েরকৃত আমলযোগ্য অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত ও জরিমানা আরোপ করা হলে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ধারা ৭৬(৪) অনুযায়ী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগকারীকে প্রদান করা হবে।

পরিশেষে বলা যায়, ভোক্তা অধিকার আইন সম্বন্ধে ভোক্তারা অসচেতন ও অজ্ঞতার ধরন অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণা সহজ হয়েছে অনেকাংশেই। ভোক্তা-অধিকার সুরক্ষার সঙ্গে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত। এটা অবশ্যই জাতীয় জরুরি সেবা পর্যায়ের ইস্যু, তাই সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাওয়া উচিত।

লেখক : শারফুদ্দীন সোহেল, সাংবাদিক।